যেভাবে আমি দিনে ফিরি

আসসালামু আলাইকুম কেমন আছেন সবাই?  আশা করি ভাল আছেন, আমিও আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আজকে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করব যেভাবে আমি দিনে ফিরি নিয়ে কিছু কথা । যেভাবে আমি দিনে ফিরি সম্পর্কে জানতে আমার আজকের আর্টিকেলটি পড়তে থাকুন।




আমার মুসলিম পরিবারে জন্ম আলহামদুলিল্লাহ! মুসলিম পরিবেশেই বেড়ে ওঠা। কিন্তু শুধু নামেই মুসলিম ছিলাম আমরা। আমার বাবা-মা ইসলাম সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানত এবং মানারও চেষ্টা করত, কিন্তু আমি ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক কিছু বিষয় ছাড়া তেমন কিছু জানতাম না। যেমন মদ হারাম, সুদ হারাম, শুকরের মাংস খাওয়া হারাম, মুসলমানরা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, বছরে একমাস রোজা রাখে... এরকম প্রাথমিক কিছু বিষয় আমার জানা ছিল। আমরা এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠি, যেখানে প্রচুর হারাম কাজ ঘটত, শুধু ঘটতই না বরং বলা যায় হারামকে উৎসাহিত করা হতো। আপনারা জানেন বর্তমান সাউথ আফ্রিকার মুসলিম কমিউনিটি বেশ সক্রিয়। 


সেখানে একজন মুসলিম ছেলে-মেয়ে চাইলেই অন্যদের মতো প্রকাশ্যে বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারে না। হারাম কাজে জড়াতে পারে না। কিন্তু আমাদের সময়ে অবস্থা এরকম ছিল না। এরপর আমরা সিডনিতে চলে আসি, আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু সাউথ আফ্রিকায় তখন হারামকে হারাম মনে করা হতো না, লজ্জাজনক ব্যাপার বলে মনে করা হতো না। এভাবেই বিরূপ পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠি। এককথায় বলা যায়, হারাম পরিবেশে...।


তবে আমি দীনকে তখনো ভালোবাসতাম। ইসলামকে শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু দীন আমার জীবনে ছিল না।

একজন সাউথ আফ্রিকান মুসলিমের কাছেই আমি দীন বুঝেছি এবং দীনে এসেছি। আলহামদুলিল্লাহ!

তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন শাইখ আহমাদ দিদাত রাহিমাহুল্লাহ! আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন। সত্যিই তিনি একজন বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন।


আমি যখন প্রথম তার লেকচার দেখি, অভিভূত হয়ে যাই। কী চমৎকার আইডিয়া! বিশাল স্টেজে দাঁড়িয়ে ইসলাম সম্পর্কে কী দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে শ্রোতাদের সামনে একজন মুসলিম আলোচনা করছেন! আমি তার ভক্ত বনে যাই। সত্যিই অনেক কঠিন ভক্ত হয়ে যাই তার!


সুবহানাল্লাহ, এরপর আল্লাহ আমাকে দীনের বুঝ দান করেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমি এভাবেই দীনে ফিরে আসি। (শ্রোতাদের সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ!)

সঞ্চালক : আমরা আশা করি ইনশাআল্লাহ! অনেক যুবক আপনার এই দীনে ফেরার গল্প জানতে পারবে এবং দীনে ফিরতে অনুপ্রেরণা পাবে। এরপর আপনার জীবনে পরিবর্তন ঘটে, সুবহানাল্লাহ! দীন সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে আপনি মনোযোগী হন। কিন্তু আপনার ফেলে আসা জীবনের বন্ধুবান্ধবী, বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিষয়, চাকচিক্যময় স্থানের জন্য কেমন বোধ করেন?

হোবলস: কোনো অনুতাপ নেই! আল্লাহর কসম! কোনো অনুতাপ, অনুযোগ নেই। 


আসলে অতীতে আমার তেমন পাপপঙ্কিলতার ঘটনা নেই, তেমন কোনো আবেগিক ঘটনাও নেই, যে কারণে আমাকে খুব বেশি আপ্লুত হতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু সবকিছু তো আর শেষ হয়ে যায় না (অর্থাৎ দীনে আসার পরও জাহিলি সময়ের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হতো), যেটা ঘটেছে সেটা হলো আমার জাহিলি সময়ের সংস্রব দীনে আসার পর কাজে লেগেছে। আমার দাওয়াহর কাজে ভালো হয়েছে। তার মানে এই নয় যে-আমি বলছি, যুবকরা দীনের পাশাপাশি জাহিলি কর্মকাণ্ড করেই যাবেন, বরং জাহিলি বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতিকে দীনের কাজে ব্যবহার করবেন।

সঞ্চালক: আমরা আশা করি সিডনির অসংখ্য যুবক আপনার লেকচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে দীনি জীবনযাপনে অভ্যস্ত হবেন। ইনশাআল্লাহ! এখন আমি জানতে চাই যুবকদের আকৃষ্ট করতে হলে আমাদের কী করা উচিত? কীভাবে আমরা দীনকে তাদের সামনে উপস্থাপন করব?

হোবলস: কতটা সত্য বলব? (তিক্ত সত্য হলেও সেটা বলব কি না?)

সঞ্চালক: যতটা সত্য আপনার হৃদয়ে আছে এবং যেগুলো বলা প্রয়োজন (যেভাবে আপনার মনে চায়) বলুন।

হোবলস: ঠিক আছে, বলছি। সত্যি করে যদি বলি, আমি অনেক বৈপরীত্য দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখাই একভাবে, কিন্তু বাস্তবে হয় ভিন্ন। আমরা শুধু বলি যে, তরুণদের জন্য (দীনি কাজ) করতে হবে, তরুণদের জন্য (দীনি কাজ) করতে হবে। এমনকি অনেক বড়ো বড়ো সংগঠন, ব্যাপক মিডিয়া হাইলাইটস, কিন্তু সেখানেও একই সমস্যা। আমরা যুবকদের নিয়ে আয়োজন করি, সেখানে তারা আসে, তাদের প্রশ্নের উত্তর দিই, কিন্তু তাদের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিই না। তাদের কোনো কাজ বা পদ দিই না। 


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, "নুসিরতু বিশ-শাবাব" আমি যুবকদের থেকেই সাহায্য পেয়েছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুবকদের খুব ভালোবাসতেন। যুবকদের রয়েছে সুন্দর মন, শক্তি, সামর্থ্য ও উদ্যম। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ, আমাদের মরুব্বি, আমাদের আলিমদের তাদের নিয়ে ভাবতে হবে; আরও দূরদর্শিতার সাথে তাদের কাজে লাগাতে হবে। এমনিতেই আমাদের কাঁচামাল (যুবশক্তি) কম, তাই আমাদের আরও আন্তরিক হতে হবে। 


বিশেষ করে যুবকরা যখন জাহিলিয়াত ছেড়ে নতুন দীনে আসে, তখন তারা অনেক বেশি উদ্যমী থাকে। জ্ঞানার্জনে ক্ষুধার্ত থাকে। তারা তখন বেশি করে জানতে চায়, আমল করতে চায়। তখনই কমপ্লিট দীন চায়। এটা খারাপ না ভালো, আমি সে ব্যাপারে বলব না। কিন্তু আমাদের উচিত তাদের আরও উৎসাহ দেওয়া। আমরা দেখি-আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো, আমাদের সংগঠনগুলো সেই পঞ্চাশ বছর আগেকার ধ্যানধারণা নিয়ে তাদের বিচার করে। ওহে বিচারক! তাদের সন্তান, তাদের নাতি-নাতনিদের যুগ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং তাদের সাথে গতানুগতিক আচরণ বাদ দিতে হবে।


সঞ্চালক: খুব সুন্দর বলেছেন। আপনি একটু আগে বললেন যে, সাউথ আফ্রিকার মুসলিম কমিউনিটি অনেক সমৃদ্ধ, অনেক সুশৃঙ্খল এবং সচেতন। দয়া করে বলবেন কি, ঠিক কোন কোন দিক থেকে বর্তমান অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম কমিউনিটি এবং সাউথ আফ্রিকান মুসলিম কমিউনিটি সমপর্যায়ের কিংবা ব্যতিক্রম?

হোবলস: হুম, আমি বলব। আমি রাজনৈতিক কোনো কথা বলব না, একেবারে খাঁটি কথা বলব-হে সাউথ আফ্রিকাবাসী! আপনারা অনেক চমৎকার পরিবেশে আছেন। আলহামদুলিল্লাহ, অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় অনেক অনেক রহমতি পরিবেশে আছেন। আর যেসব ভাই, যেসব উলামায়ে কেরাম এরকম সুন্দর পরিবেশ, এত সমৃদ্ধ কমিউনিটি গঠনে কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন এবং করে যাচ্ছেন, তাদের জন্য দুআ ও কৃতজ্ঞতা।


মাশাআল্লাহ! আপনাদের ওখানে হিফজ থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার জন্য অনেক মাদরাসা রয়েছে। অনেক আলিম, অনেক দাঈ রয়েছেন। অবশ্যই অস্ট্রেলিয়াতে আমাদের এত সুবিধা নেই। সেখানকার কমিউনিটি সেই তুলনায় অনেক নতুন। সেখানকার অধিকাংশ আলিম পঞ্চাশ বছরের নিচে। আপনাদের এখানে অনেক বয়স্ক আলিম, তাদের সন্তানরা আলিম, তাদের নাতিরা আলিম দেখা যায়। এই জিনিসগুলো আমাদের ওখানে নেই। 


কিন্তু আমার মনে হয় অস্ট্রেলিয়ায় দ্রুত মুসলিম কমিউনিটি সম্প্রসারিত হচ্ছে। সে তুলনায় সাউথ আফ্রিকায় প্রসারণ কম। এখানে অনেক ছাত্র হিফজ পড়ছে। হিফজ শেষ করে আলিম হচ্ছে। কিন্তু সে আসলে দীনের জন্য তেমন কিছু করছে না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে মুসলিমদের জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করতে দেখেছি। আলিম হওয়ার পরপরই তারা সালাতের ইমামতিতে লেগে যান। দীনের কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নেন। আসলে প্রতিটি অঞ্চলেই দীনের কাজে উত্থান-পতন আছে।





সঞ্চালক: সম্প্রতি (এপ্রিল ২০১৮ খ্রি.) আমরা দেখেছি অস্ট্রেলিয়ার একজন দাজ মারা যান, আর তার মৃত্যুর খবর খুব ভাইরাল হয়। তার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন...।

হোবলস: হুম। আপনি খিজির খানজের কথা বলছেন। তিনি আমার খুব ঘনিষ্ঠ,

আমাদের নিকটস্থ মসজিদের মুসল্লি ছিলেন। সুবহানাল্লাহ, তিনি আমাদের মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেন। তার ব্যবসা ছিল। তার পরিবার ছিল। বয়স হয়েছিল মাত্র ৪১। তার ছোটো ভাই আফ্রিকায় এসেছিল পড়াশোনা করতে। শুনেছি হাফিজ হয়েছে। সে নিয়মিত ফজরে মসজিদে আসতেন। জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করতেন। সালাত শেষে মসজিদের এক কোনায় বসে কুরআন হিফজ করতেন। এরপর বাসায় ফিরে যেতেন। সকাল নয়টায় বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। 


এভাবেই জীবনযাপন করতে দেখেছি তাকে। বহু বছর ধরেই তাকে আমি চিনি। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে-তিনি প্রতিদিন ফজরের পরে এক লাইন করে কুরআন মুখস্থ করতেন। খুব চেষ্টা করতেন মুখস্থ করতে। মুখস্থ হতে চাইত না, কিন্তু তিনি অনবরত চেষ্টা করেই যেতেন। আমার মনে পড়ে, তিনি পুরো এক সপ্তাহ জুড়ে একটি আয়াত মুখস্থ করতে চেষ্টা করতেন, পুরো এক সপ্তাহ! সুবহানাল্লাহ!! ধৈর্য সহকারে তিনি চেষ্টা করেই যেতেন।


তিনি সাউথ আফ্রিকায় চলে গিয়েছিলেন উমরা করার দু মাস আগে। সেখানে তার ভাই, তার মা-সহ আত্মীয়স্বজন থাকে। দু মাস পর আমি যখন তাকে মক্কায় দেখলাম, অবাক হয়ে গেলাম। মাশাআল্লাহ! তার চেহারা নুরে জ্বলজ্বল করছিল। দুজনে হাসি বিনিময় করলাম। তিনি জানালেন যে, তিনি সাউথ আফ্রিকায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার রক্তশূন্যতা, ভিটামিনের অভাব বা এই জাতীয় সমস্যা দেখা দিয়েছে। সুবহানাল্লাহ! আমি তার সাথে দুদিন মক্কায় কাটাই। উমরা করি। পরদিন সকালে আমি সিডনির উদ্দেশ্যে বিমানে উঠি, আর তিনি মদিনার গাড়ি ধরেন। মদিনায় সারা দিন কাটান। জোহরের সালাত আদায় করেন রওজা মুবারকের ইমামের পেছনে। প্রায় দুই ঘন্টা সেখানে জিকির-আজকার করেন। দুআ-দুরুদ পড়েন। 


এরপর বাসায় ফিরে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। তার পরিবারের লোকজন বুঝতে পারেননি যে, তার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। পরে তারা অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন এবং মাগরিবের আজানের সময় তার মৃত্যু হয়। সুবহানাল্লাহ! কী সুন্দর মৃত্যু! এরপর তার জানাজা হয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা চত্বরেই। সুবহানাল্লাহ! তিনি কত ভাগ্যবান। জান্নাতুল বাকিতে তার দাফন হয়। আমি একটা জিনিস লক্ষ করলাম একমাত্র ইসলামেই মানুষের মৃত্যু নিয়েও ঈর্ষা করা হয়। আল্লাহ যদি কাউকে উত্তম মৃত্যু দেন, তখন আমরা তাকে নিয়ে ঈর্ষা করি।


এখানে আমাদের চিন্তার একটু ত্রুটি আছে। আমরা মনে করি ভাইটি ভাগ্যবান। ভাইটির কত সুন্দর মৃত্যু হলো! কিন্তু আল্লাহ তায়ালা কাউকে কোনো কিছু এমনি এমনি দিয়ে দেন না। এর পেছনে তার চেষ্টা থাকতে হয়। ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমি বিশ্বাস করি, এই ভাইটি আল্লাহ তায়ালার কাছে এরকম মৃত্যুই কামনা করেছেন (তার আমল দিয়ে এবং চেষ্টা দিয়ে)।


Previous Post Next Post

نموذج الاتصال