একুশ শতকের এতিম

বিসমিল্লাহ ওয়াল-হামদুলিল্লাহ। ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসুলিল্লাহ। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি এ বিশাল সাত আসমান ও জমিনের মালিক, রাজাধিরাজ, সর্বশক্তিমান। দুরুদ ও সালাম মানবতার নবি, রহমতের নবি ও শেষনবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর।



এমন কোনো স্থানে আমি যাইনি যেখানে দেখিনি কিছু বাবা কিংবা মা কিংবা উভয়ে এসে আমাকে উদ্বেগের সাথে অনুরোধ করেননি- 'প্লিজ ব্রাদার! আপনি আমাদের সন্তানদের বোঝান। পিতা-মাতার অধিকার নিয়ে আলোচনা করুন। ওদের নাসিহা দিন।'

এরকম অসংখ্যবার মুখোমুখি হয়েছি। দেখেছি চোখেমুখে হতাশা নিয়ে বাবা-মা বিলাপ করছেন, তাদের যুবক সন্তানরা কথা শুনছে না, তরুণ ছেলে-মেয়েরা গোল্লায় চলে যাচ্ছে, বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

হ্যাঁ, আমি এখন আপনাদের সেই সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলব। আপনাদের অভিযোগের ঠিক বিপরীত দিক থেকে কথা বলব। এটা ঠিক, তরুণ-যুবকরা অনেক অবাধ্য হয়ে উঠছে। তাদের মধ্যে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে, কিন্তু আমি মনে করি তার চেয়ে বড়ো সমস্যা সন্তানদের বাবা-মায়েরা। আমি মনে করি, একজন তরুণ আসলে একটি পরিবারের ভেতরের পরিবেশরই প্রতিচ্ছবি। বাবা মায়ের চরিত্রের প্রভাব সন্তানের ওপর ব্যাপকভাবে পড়ে।

একজন তরুণ বা যুবকের দিকে আঙুল তোলা খুবই সহজ...। ছেলেটা কীসব করছে...! ছেলেটা কথা শুনছে না...! ছেলেটা শেষ হয়ে গেল!

এর মূল কারণ আপনি আর আমি। কারণ আমি-আপনি অসচেতন...। আমি- আপনি জানি না-তাদের সাথে কী ধরনের কথা বলতে হবে, তাদের সাথে কী


আচরণ করতে হবে। বাবা জানে না তার দায়িত্ব কী! মা জানে না তার করণীয় কী! আপনারা আগ থেকে জেনে এসেছেন, আমরা সাধারণত এতিম বলি এমন শিশুকে, যার বাবা অথবা মায়ের যে-কোনো একজন নেই। মা অথবা বাবার আদর

থেকে তারা বঞ্চিত। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা দেখছি, ছেলে- মেয়েদের মা-ও আছে বাবাও আছে, তথাপি বাবা কিংবা মায়ের সাথে তাদের সম্পৃক্তি নেই। তারা একুশ শতকের এতিম। আমি নিজে বিভিন্নজনের বাসায় গিয়ে এসব নিজ চোখে দেখেছি। সেই মা-বাবা আবার আমার কাছে এসে বলছেন- ভাই! আমার সন্তানদের একটু পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা দিন, নসিহত করুন, যাতে আমাদের সাথে সুন্দর আচরণ করে।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, যখন আপনি-আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যখন সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেটা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। সেটা এক দীর্ঘ জার্নি (সেই সময়ে আমাদের জেনে নেওয়া উচিত ছিল, সন্তানের অধিকার কী, বাবা-মায়ের অধিকার কী)। সন্তানদের সাথে আমাদের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়া দরকার, কেননা তারাই আমাদের কাঁচামাল। তারাই আমাদের মূল সম্পদ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমি যেখানেই বাবা-মায়ের সাথে কথা বলেছি, দেখেছি-ওয়াল্লাহি ! 


তারা এ ব্যাপারে খুবই অনাগ্রহী। আবার যখন ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলেছি-তারা বলেছে, তারা তাদের বাবা-মা'কে ঘৃণা করে। আমি বললাম, কেন? ছেলেটি বলল, আমার বাবা-মার সাথে আমার আসলে তেমন যোগাযোগ নেই। আমি স্কুল থেকে এসে যখন তাদের সাথে কথা বলতে চাই, কিন্তু পাই না। তারা তাদের কাজে ব্যস্ত থাকে।


আরেকবার এক ছেলের সাথে তার বাবার সম্পর্ক খারাপ জেনে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? তোমার বাবার সাথে তোমার সম্পর্ক খারাপ কেন? কী হয়েছে, আমাকে বলো। সে বলল-"সত্যি বলতে আমি আমার বাবাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করি। কারণ, সে আমার খোঁজ-খবর নেয় না। আমার সাথে কখনো কোনো কথা বলে না। এমনকি আমি যখন বাবার সাথে কোনো কথা বলি, সে তখন সঠিকভাবে মনোযোগ দেয় না। অবহেলা করে। মন্দ কথা বলে। বলে-'তুমি একটা হতচ্ছাড়া, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!' আমি গেলাম বাবার পক্ষে কথা বলতে, উল্টো বাবার কিছুই বিরুদ্ধেই অভিযোগ শুনতে হলো।

সে ছেলে আরও বলল-'আমি যা করি না কেন, তিনি রেগে যান, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন।'" তো ভাই এবং বোনেরা, এই হলো সন্তানদের সাথে আমাদের অবস্থা।

প্রিয় ভাই-বোনেরা, শিশুদের দিকে আঙুল তোলা যায়, অনেক ভুল ধরা যায়।

১ ২ ৩ ৪ বলে বলে ভুলের বিশাল তালিকা করা যায়, কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই। আঙুলটা নিজের দিকে তুলুন। নিজের ভুলগুলো ধরতে শিখুন। একজন বাবা হিসেবে, একজন মা হিসেবে নিজের ভুলগুলো দেখুন। আপনি কী নিয়ে এত ব্যস্ত? কোন দিকে আপনি এত মনোযোগ দিচ্ছেন? ভাবুন। সাউথ আফ্রিকার একজন শাইখের কাছ থেকে একটি গল্প শুনেছিলাম। সত্যি

ঘটনা। একজন বাবা খুবই ব্যস্ত। একদিন তিনি বাসায় ফিরলেন। ব্যবসার ব্যস্ততা, ফোন কল এবং অনলাইন চ্যাটিংয়ে তিনি তখনো ব্যস্ত। বাসায় তার ছোটো সন্তান সারা দিন তার অপেক্ষায় থাকার পর তার সামনে আসে। তবুও তার ব্যস্ততা কমে না। সন্তান এসে কথা বলতে চায়। তার স্কুলে আজ কী হয়েছে, তার দিনকাল কেমন যাচ্ছে ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করতে চায়। কিন্তু বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে- 'দেখছনা, আমি এখন ব্যস্ত আছি! দেখছ না আমার অনেক কাজ! তুমি তোমার রুমে যাও।


তোমাকে যে আইপ্যাড কিনে দিয়েছি তাতে গেম খেলো।' ছেলেটি চলে যায়। মনে কষ্ট নিয়ে সে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি তার বাবার কাছে এসে কিছু টাকা চায়। বাবাও বেশি কিছু জিজ্ঞেস না করে টাকা দিয়ে দেয়। ছেলেটি তার রুমে চলে যায়। কিছু সময় পর বাবা শান্ত হন। মা তার কাজ শেষ করেন। বেশ কিছুক্ষণ পর সন্তান কাছে আসছে না দেখে ছেলের রুমে যান। দেখেন, ছেলে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মাথার কাছে গিয়ে মুখ তুলে দেখেন, ছেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাবা তখন বুঝতে পারেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেন। ছেলেটি তখন তার বালিশ উঁচিয়ে দেখায় বালিশের নিচে কিছু টাকা জমানো। সে তার বাবাকে বলে- 'বাবা আমাকে বলো, এক ঘণ্টায় তোমার ইনকাম কত টাকা?


বলো, এক ঘণ্টায় তোমার কত টাকা ইনকাম? আমি এই টাকাগুলো জমিয়েছি, কারণ আমি তোমার

এক ঘণ্টা সময় কিনতে চাই। এক ঘণ্টা সময় তুমি আমার সাথে থাকবে, আর এ সময় কোনো ফোনকল, কোনো চ্যাটিং, কোনো ব্যস্ততা থাকবে না তোমার। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি এই টাকা জমিয়ে রাখছি তোমার সাথে এক ঘণ্টা সময় কাটাব বলে।'

সম্মানিত ভাইবোনেরা, আমি আপনাদের সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি, বলুন তো শেষ কবে আপনার সন্তানের সাথে আপনি মন খুলে কথা বলেছেন? কবে জিজ্ঞেস করেছেন, কোন কোন বিষয়ে তারা আগ্রহী? কবে জানতে চেয়েছেন, তারা কী পছন্দ করে, কী পছন্দ করে না? 


আমি একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি শেষ কবে তার সন্তানের সাথে খেলা করেছেন, তিনি বলতে পারেননি। তাদের সাথে বসুন। খেলাধুলা করুন। অন্তরঙ্গ হোন। সত্য হলো এটাই যে, অধিকাংশই এসব করেন না। আমরা এই কাজ সেই


কাজ নানান কাজে ব্যস্ত, ব্যস্ত, ব্যস্ত...। এমনকি আমি নিজেও পারি না। আমার স্ত্রী বলে, তোমার ছেলে মুহাম্মাদ তোমার সাথে কথা বলতে চায়। তার সাথে কথা বলো। ফোন রাখো। ফোন রাখো। তাকে সময় দাও। কিন্তু আমি ব্যস্ত। এভাবেই আমরা যখন ঘরে থাকি তখনো আমরা আসলে ঘরে থাকি না, থাকি ফোনে। থাকি

অন্য কোনো জায়গায়।


প্যারেন্টিং বা সন্তান লালন-পালন হচ্ছে আপনার করা কাজের মধ্যে সবচেয়ে

উত্তম কাজ। অথচ আমরা অনেকেই এক ছাদের নিচে বসবাস করেও অনেক দূরে থাকি। স্বামী এক জগতে, স্ত্রী অন্য জগতে, সন্তান আরেক জগতে। যার যার জগতে সে সে ব্যস্ত। এ কারণেই সন্তানরা অবাধ্য হচ্ছে। সংসারে কোনো একতা নেই। পরিবারে শান্তি নেই।

পরিবারে শান্তি পেতে চাইলে সেজন্য কাজ করতে হবে। মনোযোগী হতে হবে। চেষ্টা করে যেতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'উত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। তিনি তার পরিবারের কাছে উত্তম ছিলেন।


" সত্যিকার অর্থে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পৃথিবীর একজন ব্যস্ততম মানুষ। কিন্তু তারপরও তিনি তার পরিবারকে সময় দিয়ে গেছেন। আপনি যদি আপনার ব্যবসা বা কাজে ১০ ঘণ্টার মতো সময় দেন, তো সেটা ঠিক আছে। কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় দিলে এই ছোট্ট ব্যবসার কারণে ইবাদতের সাথে, কুরআনের সাথে, পরিবারের সাথে, স্ত্রীর সাথে, সন্তানদের সাথে এবং প্রতিবেশীর সাথে আপনার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। আপনি আমাদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা কল্পনা করুন। 


কল্পনা করুন পৃথিবীর একজন ব্যস্ততম মানুষের জীবন। তিনি ছিলেন এমন একজন, যার দিকে তাকিয়ে থাকত পুরো উম্মাহ। যার ওপর নাজিল হতো কুরআন। মানুষের বিভিন্ন বিপদাপদে পরামর্শ দিতে হতো। দাওয়াহর কাজ করতে হতো। সমাজের একেক জনের একেক সমস্যা নিয়ে আসত, আর তাকে সে সবের সমাধান দিতে হতো। কারও বিয়ের সমস্যা, কারও আর্থিক সমস্যা, এদিকে সমস্যা, ওদিকে সমস্যা। চব্বিশ ঘণ্টা তাকে মানুষের এসব সমস্যার সমাধান করতে হতো। এত কিছুর পরও তিনি তাঁর পরিবারের জন্য সময় রাখতেন। সন্তানদের জন্য সময় রাখতেন। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি খাতের জন্য সময় বরাদ্দ রাখতেন।


Previous Post Next Post

نموذج الاتصال